
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর মুগদা থেকে মান্ডা পর্যন্ত গোটা এলাকাটি এখন মাদকের এক “স্বর্গরাজ্য”। সকাল থেকে গভীর রাত—প্রতিটি অলিগলি যেন মরণ নেশার আখড়া। প্রশাসনের নাকের ডগায়ই চলছে কোটি টাকার মাদক বাণিজ্য, তবুও রহস্যজনক নীরবতা।

জনসম্মুখেই মাদক বেচাকেনা : সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়—মুগদা স্টেডিয়ামের সামনে ও পেছনের অংশে প্রতিদিনই খোলাখুলি বেচাকেনা হচ্ছে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল ও হিরোইন। মুগদা বড় বাজার, গার্মেন্টস গলি, দক্ষিণ মুগদা মসজিদ গলি, মান্ডা খালপাড়, মুড়িয়ালী গলি, মদিনাবাগ ও মানিকনগর বালুর মাঠ—এসব এলাকাতেও একই চিত্র।
স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে মুখ খুলতে চান না। তাদের অভিযোগ, “সবাই জানে কে কারে চালায়, কিন্তু প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে।”

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেপরোয়া ব্যবসা : এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রভাবেই এই মাদক সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে। দলের নামে ও ছত্রছায়ায় পরিচালিত এই চক্র প্রশাসনের ভেতরের একটি অংশের সাথেও গভীরভাবে যুক্ত।

একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ী বলেন, “থানার ভেতরেও আমাদের লোক আছে। টাকা দিলে সব চুপ থাকে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও মাসিক চাঁদা নেন।”
অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য : তদন্তে জানা গেছে, মাদক ও জুয়া চক্র প্রতি সপ্তাহে মোটা অঙ্কের টাকা দেয় স্থানীয় থানার কিছু অসাধু কর্মকর্তা, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তাদের এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। ফলে, অভিযান হয় ‘দেখানো’, আর ব্যবসা চলে আগের চেয়ে আরও বিস্তৃতভাবে।
এক সিন্ডিকেট সদস্য সরাসরি স্বীকার করেছে, “আমরা থানাকে দেই, অধিদপ্তরেও দেই। দলের প্রোগ্রামে কিশোর গ্যাং পাঠাই—তাই আমাদের ব্যবসা বন্ধ করতে কেউ পারবে না।”
কিশোর গ্যাং: রাজনীতির নতুন অস্ত্র : মুগদা–মান্ডা অঞ্চলের কিশোর গ্যাংগুলোকেই এখন ব্যবহার করা হচ্ছে মাদক পরিবহন ও ‘সুরক্ষা বাহিনী’ হিসেবে। রাজনৈতিক সভা–সমাবেশ, মিছিল, এমনকি নির্বাচনী প্রচারণাতেও তাদের ভাড়া করা হয়। প্রতিদান হিসেবে তারা পায় অর্থ, মাদক ও অপরাধে অংশগ্রহণের ‘সুযোগ’।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এই কিশোরদের বড় অংশই স্কুলছুট, এবং অল্প বয়সেই তারা মারাত্মক নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে।
জুয়াখেলা ও অপরাধের অন্ধকার জগৎ : মাদক ব্যবসার পাশাপাশি জুয়ার আসরেও জমজমাট ব্যবসা চলছে মান্ডা, মুগদা ও মানিকনগরে। প্রায় দুই ডজন জুয়ার স্পটে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বাজি ধরছে জুয়াড়িরা। এই আসরগুলোকে ঘিরে মারামারি, ছিনতাই ও সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
ধ্বংসের পথে তরুণ সমাজ : বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর এই মাদকচক্র শুধু আর্থিক নয়, সামাজিক বিপর্যয়ও ডেকে আনছে। তরুণ প্রজন্ম হারাচ্ছে দিকনির্দেশনা, কিশোর অপরাধ বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। প্রতিদিনই নতুন নতুন কিশোর যোগ দিচ্ছে এই মরণচক্রে।
প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ : এলাকাবাসীর দাবি, প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও স্বচ্ছ অভিযান না হলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই।
এক প্রবীণ নাগরিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এখানে পুলিশ আছে, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আছে—কিন্তু কাজ করে না। যতদিন টাকা চলে, ততদিনই এই ব্যবসা টিকে থাকবে।”
সমাধান কোথায় ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনের আন্তরিকতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সামাজিক সচেতনতা—এই তিনের সমন্বয় ছাড়া রাজধানীর মুগদা–মান্ডা এলাকা থেকে মাদকের অন্ধকার সরানো সম্ভব নয়। নতুবা এই অঞ্চল থেকেই রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার।
