
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাষ্ট্রীয় খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত—সরকারি খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থা—ঢাকা বিভাগে পরিণত হয়েছে একটি সংগঠিত ঘুষ–সিন্ডিকেটের আখড়ায়। সড়ক পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগের নামে ৩০ কোটি টাকার বেশি ঘুষ বাণিজ্য, নথি জিম্মি, দরপত্র কারসাজি ও ভয়ভীতির অভিযোগে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আবুল হাসনাত হুমায়ূন কবীর এবং ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

গত ৯ ডিসেম্বর, রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এই অভিযোগ দাখিল করেন আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা সুফি সাগর শামস। অভিযোগপত্রে খাদ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত একটি ঘুষ–নির্ভর প্রশাসনিক নেটওয়ার্কের নগ্ন চিত্র উঠে এসেছে।
৮১৯ ঠিকাদারকে বাদ দিয়ে ‘পছন্দের ৩০০’: শুরু হয় ঘুষের হিসাব : অভিযোগে বলা হয়, খাদ্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত ৮১৯টি পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা বাতিল করে ব্যক্তিস্বার্থে মাত্র ৩০০টির মতো প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই তালিকায় ঢোকার মূল্য ধরা হয় প্রতি প্রতিষ্ঠান ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। হিসাব করলে ঘুষের অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এই পুরো প্রক্রিয়ায় মহাপরিচালক মো. আবুল হাসনাত হুমায়ূন কবীর ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুনের পরস্পর যোগসাজশ ও প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে অভিযোগে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ডিজির ছায়ায় আরএফসির ‘ঘুষ সংগ্রহ সেল’ : অভিযোগ অনুযায়ী, ঘুষ আদায়ের মাঠপর্যায়ের কাজ পরিচালনা করেন আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন। তিনি সরাসরি টাকা না নিয়ে কয়েকজন প্রভাবশালী ঠিকাদারকে এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করেন। অভিযোগে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন, আবুল কালাম আজাদ (জননী এন্টারপ্রাইজ), জাহাঙ্গীর আলম (সেতারা অ্যান্ড সন্স), আব্দুল হাই রাজু (এ. হাইএন্ড ব্রাদার্স), আনসার হাজী (তালুকদার এন্টারপ্রাইজ), আলী নূর (এ আর এন্টারপ্রাইজ) এবং হারুন অর রশিদ (রিমি এন্টারপ্রাইজ) এই এজেন্টদের মাধ্যমে ঘুষ সংগ্রহ করে নির্বাচিত তালিকায় নাম তোলার নিশ্চয়তা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।

ই-টেন্ডারের আড়ালে নথি জব্দ, দরপত্র নয়—জিম্মিদারি : গত ২২ সেপ্টেম্বর ই-চালানের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হলেও বাস্তবে ই-টেন্ডার ব্যবস্থা কার্যত জিম্মি করে নেওয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, ভালো দর নির্ধারণের প্রলোভন দেখিয়ে ঠিকাদারদের আর্থিক ও কারিগরি নথি সরাসরি নিজের হেফাজতে নেন সুরাইয়া খাতুন। দরপত্র জমার দিনে যারা ঘুষ দিয়েছেন, তাদের নথি ‘ক্লিন’ করে কার্যকর রাখা হয়। আর যারা ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাদের নথি ফেরত না দিয়ে ব্লক করে প্রতিযোগিতার বাইরে ছুড়ে ফেলা হয়।
একই কলমে লেখা দর : রাষ্ট্রীয় দরপত্রে হাতের লেখা ‘কার্বন কপি’ করার অভিযোগ উঠেছে, দুদকে দাখিল করা অভিযোগে সবচেয়ে ভয়ংকর যে তথ্য উঠে এসেছে তা হলো—প্রায় ৪৬৭ জন ঠিকাদারের আর্থিক প্রস্তাবে পরিকল্পিতভাবে ‘ক্রস মার্ক’ ও অস্বাভাবিক উচ্চ দর দেখানো হয়। বিপরীতে নির্বাচিত ৩০০–৩৫০টি প্রতিষ্ঠানের দর একই কলম, একই হস্তাক্ষর ও একই লেখনীর প্যাটার্নে লেখা, যা সরাসরি দরপত্র কারসাজির অকাট্য প্রমাণ বলে অভিযোগকারীর দাবি। প্রশ্ন উঠছে—রাষ্ট্রীয় দরপত্রে এই একই হাতের লেখা এল কোথা থেকে? কার অফিসে বসে লেখা হলো শত শত দরপত্র?
কমিউনিটি সেন্টারে ‘স্বাক্ষর সন্ত্রাস’ : অভিযোগে আরও বলা হয়, ২৪ অক্টোবর, চিটাগাং রোডের একটি তাজমহল কমিউনিটি সেন্টারে সাধারণ ঠিকাদারদের ডেকে এনে জোরপূর্বক দরপত্র নথিতে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। যারা স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাদের প্রকাশ্যে ভয়ভীতি দেখিয়ে বের করে দেওয়া হয়। অভিযোগকারীদের ভাষায়—এটি ছিল প্রশাসনিক ক্ষমতার নগ্ন অপব্যবহার।
লিখিত অভিযোগেও ডিজির নীরবতা—সম্মতির প্রমাণ ?
এই দুর্নীতির বিষয়ে মো. আলাউদ্দিন (নং-৮১৬),
মেসার্স সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ (নং-৪৬৮), মেসার্স আমির ব্রাদার্স (নং-৮৫৬) ও মেসার্স জেড এ এন্টারপ্রাইজ (নং-৮৯২) গত ২৩ অক্টোবর মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগকারীদের মতে, এই নীরবতা নিজেই দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত।
পুরোনো অভিযোগের ছায়া : পরিবহন পুল থেকে বিদেশে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে আরও দাবি করা হয়, বর্তমান মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে অতীতেও সরকারি পরিবহন পুলে দায়িত্ব পালনকালে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং সরকারি গাড়ির তেল বিক্রি করে বিদেশে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ কখনো পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মুখ দেখেনি বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
দুদকের সামনে কঠিন প্রশ্ন : এখন প্রশ্ন উঠেছে—কার নির্দেশে শত শত দরপত্র একই হাতে লেখা হলো ? কীভাবে ই-টেন্ডার ব্যবস্থা ভেঙে ম্যানুয়াল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হলো ? ডিজির কাছে লিখিত অভিযোগ যাওয়ার পরও কেন নীরবতা ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই অভিযোগকারী দুদকের কাছে সম্পূর্ণ দরপত্র প্রক্রিয়া জব্দ করে তদন্ত, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক লেনদেন যাচাই এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
অভিযুক্ত ডিজির বক্তব্য : এ বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হাসনাত হুমায়ূন কবীর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা। আমি দুদকের সচিবকে সুষ্ঠু তদন্ত করার অনুরোধ জানিয়েছি।”
