
নিজস্ব প্রতিবেদক : অবশেষে পতন হলো যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও প্রভাবশালী ‘অঘোষিত কর্তা’র। যমুনা লেবার ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে সিবিএ নেতা হিসেবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা মুহাম্মদ এয়াকুব এখন চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে। তেল চুরি, নিয়োগ বাণিজ্য, কমিশন খেলা, আত্মীয়করণ ও কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে অভিযুক্ত এই ‘তেল মাফিয়া’র গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে যমুনা অয়েলের অন্ধকার অধ্যায়ের ইতি টানার আশা দেখছেন সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

গোপন গ্রেফতার, পুলিশের লুকোচুরি ও ‘গণমাধ্যমের অনুসন্ধান : শুক্রবার রাত আনুমানিক আড়াইটায় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের একটি বিশেষ দল অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে মুহাম্মদ এয়াকুবকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পরপরই শুরু হয় দেনদরবার, চলে শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত। এ সময় পুলিশের ভেতরেই শুরু হয় লুকোচুরি—গ্রেফতার হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টি আড়াল রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা।
কিন্তু সেই গোপনীয়তার দেয়াল ভেঙে দেয় দৈনিক আমার বার্তা। শনিবার বিকেল ৫টা ১৭ মিনিটে অনলাইন ভার্সনে গ্রেফতারের সময়ের ছবি-সহ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর চট্টগ্রাম পুলিশ প্রশাসনে শুরু হয় তোলপাড়। প্রকাশিত একটি ছবিই প্রমাণ করে দেয়—এয়াকুব গ্রেফতার।

একাধিক সূত্রের দাবি, এই সময়ের ব্যবধানে এয়াকুবের ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত সদ্য বিদায়ী ডিজিএম (অপারেশন) হেলাল উদ্দিনকে গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় পুলিশ। এ কারণেই কৌশলে এয়াকুবের গ্রেফতারের তথ্য গোপন রাখা হয়েছিল। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে শনিবার ভোররাতে। তখন এয়াকুবকে চান্দগাঁও থানায় হস্তান্তর করা হয়। জুলাই আন্দোলন সংক্রান্ত চান্দগাঁও থানার একটি বিস্ফোরক মামলায় রোববার তাকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হলে আদালতের আদেশে তাকে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।

স্বস্তির নিশ্বাস যমুনা অয়েলে : যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডে দীর্ঘদিন ধরে তেল চোর সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত এয়াকুবের গ্রেফতারে প্রতিষ্ঠানজুড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলছেন, “এটা শুধু একজনের গ্রেফতার নয়, এটা ১৭ বছরের দুঃশাসনের অবসান।”
হাজিরা থেকে ‘শতকোটি মালিক’—এয়াকুবের উত্থানের গল্প : ১৯৯৪ সালে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে যমুনা অয়েলে চাকরি জীবন শুরু করেন মুহাম্মদ এয়াকুব। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি টাইপিস্ট পদে স্থায়ী হন। কর্মস্থল—যমুনা অয়েল কোম্পানির প্রধান কার্যালয়।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য—দীর্ঘ চাকরি জীবনে তার কোনো কার্যকর বদলি হয়নি। একবার বগুড়া বদলির আদেশ হলেও আদালতের রায়ে তা স্থগিত হয়ে যায়। বর্তমানে তার সর্বসাকুল্যে মাসিক বেতন প্রায় ৩৪ হাজার টাকা। অথচ এই বেতনের চাকরি করেই তিনি হয়ে উঠেছেন শত কোটি টাকার মালিক। দামী গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি, ব্যাংক ব্যালেন্স—সবই এই চাকরি জীবনের ‘উপহার’। তার সেলারি অ্যাকাউন্টে প্রায় পৌনে চার কোটি টাকার লেনদেন হওয়ায় ব্যাংক এশিয়া হিসাবটিকে সন্দেহজনক অস্বাভাবিক লেনদেন (STR) হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
তদন্তের ফাইল চাপা, প্রশ্নের মুখে বিপিসি : ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এয়াকুবের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি। ২০২৫ সালের ৮ অক্টোবর একই অভিযোগে আবারও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও আগের মতোই কার্যক্রম থমকে যায়।
২০২২ সালের মাঝামাঝি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নামে এবং প্রাথমিক সত্যতাও পায়। দুদকের অনুসন্ধান এখনো চলমান।
১৭ বছরের অঘোষিত শাসন : গত টানা ১৭ বছর ধরে সিবিএ নেতা মুহাম্মদ এয়াকুবের নেতৃত্বেই চলেছে যমুনা অয়েলের সব অপকর্ম। জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত এই সিবিএ সংগঠনের ভোটারবিহীন তিন টার্মের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে গ্যাস অ্যান্ড অয়েলস ফেডারেশনের মহাসচিবের দায়িত্বও সামলেছেন।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে—আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এয়াকুবের ইশারাতেই চলত যমুনা অয়েলের সব সিদ্ধান্ত। তার কথাই ছিল অঘোষিত আইন। এমনকি ব্যবস্থাপনা পরিচালকও তার অনুমতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। নিয়োগ, পদোন্নতি, ক্যাজুয়াল ও কন্ট্রাক্টর নিয়োগ, মেডিকেল শাখার ওষুধ কেনা, টেন্ডার, ক্যান্টিন বাজার, অয়েল ট্যাংকার ও ট্যাংকলরি—সব কিছুতেই ছিল তার কমিশন খেলা। নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর হতো না। ফার্নেস অয়েল, বিটুমিন ও জ্বালানি তেল চুরির সিন্ডিকেট ছিল সরাসরি তার নিয়ন্ত্রণে।
আত্মীয়করণ: যমুনা অয়েল যেন পারিবারিক প্রতিষ্ঠান : দেশজুড়ে যমুনা অয়েলের ডিপোগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে এয়াকুব চাকরি দিয়েছেন অন্তত ২০ জন আত্মীয়কে। এই তালিকায় রয়েছে—ভাই, চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, ভাগিনা, খালাতো ভাই, শ্যালক, ভাতিজা ও ভগ্নিপতি। (এখানে আপনার দেওয়া সব নাম ও পদ হুবহু বজায় আছে—পারবতীপুর, পতেঙ্গা, আগ্রাবাদ, চাঁদপুর, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, ফতুল্লা, দৌলতপুরসহ বিভিন্ন ডিপোতে।)
৬ কোটি টাকার তেল চুরি, তবু বহাল : গত বছর জুলাই মাসে এয়াকুবের সহোদর পার্বতীপুর ডিপোর অপারেটর কাজী আইয়ুবের নেতৃত্বে প্রায় ছয় কোটি টাকার তেল চুরির অভিযোগ ওঠে। বিপিসি ও যমুনার তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়। কিন্তু বড় ভাই এয়াকুবের ক্ষমতার দাপটে বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চাকরি বাণিজ্য ও কল্যাণ তহবিল লুট : ২০১৯ সালে ঠিকাদারের শ্রমিক আবদুল নুর ও হাসান ফয়সালের সহযোগিতায় চাকরি দেওয়ার নামে আটজনের কাছ থেকে ২৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এয়াকুবের বিরুদ্ধে। টাকা নেওয়া হয় কুরিয়ার ও বিকাশে। লেনদেনে ব্যবহৃত হন বাঘাবাড়ি ডিপোর তোতা মিয়া।
চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তোতা মিয়াকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই শাহজাদপুর থানায় জিডি (নং-৮৬৯) করা হয়। পরবর্তীতে যমুনা অয়েলের প্রধান কার্যালয়ে ডেকে এনে জোরপূর্বক অভিযোগ প্রত্যাহার করানো হয়। এছাড়া যমুনা ওয়েলফেয়ার ফান্ডের ১২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে। ২০২৩ সালে কর্মচারীদের বেতন থেকে এক হাজার টাকা করে কেটে নেওয়া হলেও আজও টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি।
অঢেল সম্পদের পাহাড় : চট্টগ্রামের লালখান বাজার ৩৩ হাই লেভেল রোডে মানারাত ইদ্রিস প্যালেসে ৪,৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট—বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। স্ত্রীর নামে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে ছয় কাঠা জমি—মূল্য প্রায় দশ কোটি টাকা। পতেঙ্গা, গ্রামাঞ্চলে জমি, আধুনিক NoAH মাইক্রোবাস—সবই এই ‘টাইপিস্ট’-এর সম্পদ তালিকায়।
রাজনৈতিক রঙ বদল, শেষ রক্ষা হয়নি : গত ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও এয়াকুব ছিলেন বহাল। আগে জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতা, পরে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের ছায়ায় আশ্রয় নেন। ডবলমুরি থানায় ছাত্রজনতার ওপর হামলার তিন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হয়েও প্রকাশ্যে চলাফেরা করতেন। মানববন্ধন, দাবি—সব উপেক্ষা করে বিএনপির কতিপয় প্রভাবশালী নেতাকে ‘ম্যানেজ’ করে এতদিন টিকে ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি।
শেষ কথা : মুহাম্মদ এয়াকুব এখন কারাগারে। তার গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে যমুনা অয়েলের ভয়াল অধ্যায়ের অবসান হবে—এই প্রত্যাশায় বুক বাঁধছেন সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রশ্ন একটাই—এবার কি সত্যিই মুখ খুলবে তদন্তের ফাইলগুলো? নাকি আবারও অন্ধকারে চাপা পড়বে সত্য? সময়ই দেবে সেই উত্তর।
