ডায়রীর পাতা থেকে
সাবরীনা মান্নান : প্রথমবার জেলা পর্যায়ে আমাদের টিম শ্রেষ্ঠ তার্কিক দল বিবেচিত হয়ে ট্রফি নিয়ে এলো, তখন ক্লাস এইটে পড়ি,
যখন বাসায় ফিরলাম, বাবার সে কি উচ্ছাস, বলেই ফেললেন, তোমরা দেখে নিও আমার মেয়ে একদিন এ দেশের নামকরা উকিল হবে।
ছেলেবেলা থেকেই পুরনো জমিদার বাড়ি দেখলে আমার মনের মাঝে অন্যরকম একটা খেলা৷ খেলে যেতো। যতবারই কোন জমিদার বাড়ির সন্ধান পেতাম লুকিয়ে হলেও চলে যেতাম, সে ছিলো এক অন্য রকম অনুভূতি, বাড়ির গায়ে হাত দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করতাম, কতরকম অজানা গল্প লুকিয়ে আছে বাড়িকে ঘিরে, যে অভ্যাস আজ অবধি রয়ে গেছে।
তখন থেকেই আরকিওলজি পড়ার ইচ্ছে মনের মাঝে ঘাপটি মেরে বসে ছিলো। জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে এ সাবজেক্টের মেধা তালিকায় নিজের নাম দেখলাম, বাবা বরাবরের মতো আবারও উচ্ছাসিত, বাসার সবাইকে জানিয়ে দিলেন, তোমরা দেখে নিও আমার মেয়ে একদিন বিশ্বের নামকরা আরকিওলজিসট হবে।
আমার বাবা
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাদের মাঝে একজন।
বাবা, আপনি যখন স্কয়ার হাসপাতালে, অফিস শেষ করে ছুটে যেতাম, আপনি অভিমানী কন্ঠে বলতেন, এই তোমার আসার সময় হলো, ক্যানটিনে গিয়ে দেখো কি খাবার আছে। তখন আপনি হয়ে গিয়েছিলেন আমার ছোট্ট ছেলে আর আমি আপনার সারাজীবন ডেকে যাওয়া মা।
এমন কোনদিন হয়নি, কিছু চেয়েছি বাবার কাছে, তিনি দেননি। হয়তো কষ্ট হয়েছে তবুও না শব্দটি উচ্চারণ করেননি।
বাবা আপনার৷ মনে আছে, সেবার ঈদের আগের দিন, সব বন্ধুরা এসে আমার নতুন জামাটি দেখে ফেলেছিল, আমার সে কি কান্না, আমার জামা পুরানো হয়ে গেল এই ভেবে, আপনি রাতের বেলা আবারও জামা কিনে নিয়ে আসলেন।
আজকাল ঈদ আসলে মনে পড়ে সে সব দিনের কথা।
এমন করেই বটবৃক্ষের ছায়া সমেত আমার, আমাদের বাবা ছিলেন, এখনো মনে হয়, বাবা আছেন
ডাক দিলেই হয়তো শুনবো, কি মা, কিছু লাগবে?
বাবা আমার আপনাকে লাগবে।
আর একটিিবার এসে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলেন প্লিজ, মা তুমি কেমন আছো
বাবা
আপনার সেই উচ্ছাসিত উচ্চরনের নামধারী কেউই আমি হতে পারিনি।
তবে আমি আজ অন্য কিছু হয়েছি।
বাবা আমি মেঘ হয়েছি, যখন তখন রূপ বদলানো মেঘ,
যে মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হয়ে অঝোর ধারায় ঝরে পড়ে।
বাবা আমি রোদ্দুর হয়েছি,
যার উষ্ণতায় কিছু কচি গাছ তাদের ডাল-পালা মেলে খেলা করতে শেখে।
বাবা আমি সমুদ্র হতে পেরেছি
যার বুকে অজস্র বেদনার গল্প লুকিয়ে আছে তারপরও সে গর্জন করে হাসতে জানে।
আসলে কি জানেন বাবা
শহুরে রাস্তায় আর বন্দরে আমার কাগজের ঘুড়ি ওড়াতে আর ভালো লাগে না।
কাচের বয়মে যত্ন করে রাখা স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসার মহীরুহ পতনের শব্দ আজ আমাকে খানিকটা নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। আপনার সাথে মুখমুখি বসে নীরবতা পালনের গান শুনতে বড্ড ইচ্ছে করে।