!!  সুন্দরবনে পুরনো ভূত আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বনদস্যুরদের উত্থান !!  প্রায় ২০ টি দস্যু বাহিনী সক্রিয়  !!  জীবিকার বন এখন শত্রুতে পরিনত হয়েছে  ! 

Uncategorized অপরাধ আইন ও আদালত খুলনা গ্রাম বাংলার খবর জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

নইন আবু নাঈম তালুকদার, (শরণখোলা)  :  বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে ২০১৮ সালে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়েছিলো। কিন্তু এখন সেখানে আবারও অপরাধের কালো ছায়া ভর করেছে। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে এই উপকূলীয় অঞ্চলে বনদস্যুদের উত্থান তীব্রতর হয়েছে।


বিজ্ঞাপন

ফিরে এসেছে পুরনো ভূত—যারা অপহরণ, মুক্তিপণ আর নির্যাতনের নামে উপকূলকে আতঙ্কিত করছে।

যে বন ছিলো বনজীবীদের জীবিকা, তা এখন হয়ে উঠেছে শত্রু। পুরনো আত্মসমর্পণকারীদের সঙ্গে নতুন গোষ্ঠী মিলে কমপক্ষে ২০টি দস্যু বাহিনী এখানে প্রভাব বিস্তার করছে।


বিজ্ঞাপন

বিশেষ করে পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে (যেমন: মরা ভোলা, আলী বান্দা, ধঞ্চে বাড়িয়া, টিয়ার চর) তাদের দৌরাত্ম্য চরম। জেলে, বনজীবী ও ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে কাঁপছেন। সেই সঙ্গে উপকূলের অর্থনীতি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে।


বিজ্ঞাপন

গত এক মাসে সুন্দরবনে শতাধিক জেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে দস্যু বাহিনী। আক্রান্তরা দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত যৌথ অভিযান পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন। তবে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তার ভাষ্য, বনদস্যুদের সঙ্গে ফাইট করতে তেমন প্রস্তুতি তাদের নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত এক বছরে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া তিন শতাধিক জেলে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর শতাধিক জেলেকে জিম্মি করে বনদস্যুরা। এর মধ্যে অনেকেই গোপনে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করে ফিরে এসেছেন। এখনও বিভিন্ন বাহিনীর হাতে জেলেরা জিম্মি বলে জানিয়েছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা, আলী বান্দা, ধঞ্চে বাড়িয়া, তেঁতুল বাড়িয়া, টিয়ার চর, আন্ধারমানিক, পশুর, শিবশাসহ বিভিন্ন এলাকায় জলদস্যুদের বিচরণ বেশি।

বন বিভাগ, জেলে ও ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, দস্যুরা বিভিন্ন নামে দল গঠন করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আগের আত্মসমর্পণকারী বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ব্যক্তি এবং বিভিন্ন মামলার দণ্ডিতদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দলগুলো। এসব বাহিনীদের মধ্যে জাহাঙ্গীর বাহিনী, মনজুর বাহিনী, দাদা ভাই বাহিনী অস্ত্র ও সদস্য সংখ্যায় বেশি ও ভয়ঙ্কর।

এই তিন বাহিনীর সদস্যরা আগে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবন জীবনে ফিরে গিয়েছিলো। এছাড়া করিম-শরিফ বাহিনী, আসাদুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী, রাঙ্গা বাহিনী, সুমন বাহিনী, আনোয়ারুল বাহিনী, হান্নান বাহিনী ও আলিফ বাহিনীর নাম উল্লেখযোগ্য।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বন সংলগ্ন এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি দস্যুদের মধ্যস্থতাকারী ও সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। তারা অপহৃত হয়ে জিম্মি থাকা জেলেদের পরিবার ও তাদের মহাজনদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে চাঁদার টাকা আদায় করে দস্যু বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন দস্যু বাহিনী নিজ নিজ সঙ্কেত বসানো টোকেন দিচ্ছে জেলেদের। জলদস্যুর এই টোকেন নৌকায় থাকলে নিরাপদে মাছ ধরা যায় বনে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরণখোলার একাধিক মাছ ব্যবসায়ী জানান, দস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা নিরাপদ নয়। বনের পাশে জেলে মৎস্য আড়তের আশেপাশে দস্যুদের প্রতিনিধি বা সোর্স ঘোরাফেরা করে। তথ্য ফাঁসের বিষয়ে জানতে পারলে পরে বনে গেলে জেলেদের ওপরে নির্যাতন চালানো হবে, বেড়ে যাবে চাঁদার অংক। এই ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে জেলে বা মহাজন কেউই মুখ খুলছেন না।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য বনে জেলেদের পাঠালে নৌকা প্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। অপহরণের ঘটনায় মুক্তিপণ হিসেবে দিতে হয় ৫০ থেকে এক লাখ টাকা। এ কারণে অনেক জেলে এখন বনে মাছ ধরতে যেতে চান না।

কোস্টগার্ড মংলা পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আবরার হাসান বলেন, গত বছরের পাঁচ আগস্টের পর থেকে সুন্দরবনের দস্যুদের উৎপাত শুরু হয়েছে। এরপর থেকে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। দস্যু দমনে অভিযান এবং তাদের অবস্থান সনাক্তকরণে গোয়েন্দা বিভাগ কাজ করছে।

গত তিন অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ২৭টি অভিযান পরিচালনা করেছে কোস্টগার্ড। এসব অভিযানে ৪৪ জন বনদস্যু এবং তাদের সহযোগীদের আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে দেশি-বিদেশি ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র ৪৩ টি বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। এছাড়া ১৭০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, ৩৬৯টি ফাঁকা কার্তুজ, দুটি ককটেল এবং ৪৭৯ টি স্প্লেন্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি বনদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা ৪৮ জেলেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ডাকাতের সঙ্গে ফাইট করতে ওইভাবে আমাদের প্রস্তুতি তেমন নাই। কিন্তু আমরা স্টাফদের বলেছি ফায়ার আর্মস বাড়ানোর জন্য, পর্যাপ্ত স্টাফ নিয়ে যাওয়ার জন্য। দস্যুদলের তথ্য ও তালিকা আমরা অন্য বাহিনীকেও দিয়েছি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’ সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী নুর আলম শেখ বলেন, পাঁচ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সুন্দরবনে বনদস্যুদের অপতৎপরতা বেড়েছে। সুন্দরবন আগের ভয়াবহ সেই অবস্থায় ফিরেছে। বনজীবীরা বনে যেতে ভয় পাচ্ছেন, ব্যবসায়ীরাও আতঙ্কে। এমন পরিস্থিতিতে উপকূলের অর্থনীতি হুমকির মুখের পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, দস্যু দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা উচিত। এরা যে শুধু যে বনজীবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে আতঙ্ক তা’ই নয়, জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি। দস্যুতার পাশাপাশি তারা বাঘ, হরিণ শিকার করে মাংস, চামড়া ও কঙ্কাল পাচার করে। বনের মূল্যবান কাঠও পাচার করে তারা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তাদের টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, সামাজিক মর্যাদা দেওয়া জরুরি। নচেৎ আগের মতো সুন্দরবন জলদস্যুদের রাজত্বে পরিণত হব

👁️ 37 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *