আইজিপি’র যুগান্তকারী উদ্যোগ

অপরাধ

কনস্টেবল নিয়োগ

 

আবদুল গোফরান মাসুদ : পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একের পর এক যুগান্তকারী উদ্যোগে বাহিনীটির পেশাগত উৎকর্ষ সাধন ও গুণগত মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন ড. বেনজীর আহমেদ। এবার পরিবর্তন আনলেন পুলিশ সদস্য (কনস্টেবল) নিয়োগের প্রক্রিয়ায়। সংশোধন আনা হয়েছে আইনে। এখন থেকে নতুন প্রবিধানেই সারাদেশে নিয়োগ হবে পুলিশ সদস্য। একইভাবে নিয়োগ হবে এসআই, সার্জেন্ট ও টিএসআইও।
পুলিশ সদস্য নিয়োগে এই প্রথম অনলাইনে আবেদন পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। সারাদেশের আবেদনগুলো এই পদ্ধতির মাধ্যমে জমা হবে পুলিশ সদরদপ্তরে। এখান থেকেই প্রাথমিক এবং প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করা হবে। আগের মতো জেলা পর্যায়ে লাইনে দাঁড়িয়ে কনস্টেবল নিয়োগের প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া আর থাকছে না।
পুলিশ সদস্য নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং হয়রানি দূর করতেই আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাশাপাশি এই নিয়মে সময়োপযোগী দক্ষ, পেশাদার এবং যোগ্য পুলিশ সদস্য নির্বাচন সম্ভব হবে বলে মনে করেন আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের পাশাপাশি পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের পুলিশ বাহিনীকে আরও উন্নত করার অভিপ্রায় থেকেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে কনস্টেবল নিয়োগে যেমন স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে, তেমনি গুণগত মানও উন্নত হবে ।’
ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘কনস্টেবল নিয়োগের মানদণ্ডের বিষয়গুলো তুলে ধরে একটি মাল্টিমিডিয়া ভিডিও প্রকাশ করবে পুলিশ সদরদপ্তর। সেই আলোকে নিয়োগপ্রত্যাশীরা তাদের তৈরি করতে পারবেন। নিয়োগ পেতে অতীতে যে হয়রানির অভিযোগ ছিল তা দূর হবে।’
১৮৬১ সালের পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি) ও ১৯৪৩-এর কিছু প্রবিধান সংশোধন করে নতুন এই নিয়ম করা হয়েছে।
সম্প্রতি এই সংশোধনী গেজেট আকারে প্রকাশের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন নিয়মেই চলতি মাসেই সারাদেশে পুলিশ সদস্য, এসআই, সার্জেন্ট ও টিএসআইদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ সদস্য নিয়োগে পিআরবিতে আনা সংশোধনগুলোকে সময়োপযোগী হিসেবে দেখছেন বাহিনীটির সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের পরিবর্তন জরুরি। কারণ সারাবিশ্বেই পুলিশ বাহিনীকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আলোকে সাজানো হচ্ছে। আমাদের এখানেও দক্ষ জনবল নিয়োগ জরুরি।’
সাবেক এই অতিরিক্ত আইজিপি বলেন, ‘পরিবর্তিত বিশ্বে অপরাধের ধরন বেড়েছে। সেই অনুযায়ী পুলিশ সদস্যদেরও আরও চৌকস হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তাই সদস্য নিয়োগের সময়ই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা দেখে নিতে হবে।’
কী থাকছে নতুন নিয়মে?
নতুন নিয়মে পুরুষদের ক্ষেত্রে উচ্চতা হতে হবে পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি, নারীদের ক্ষেত্রে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। পুরুষ প্রার্থীদের বুকের মাপ ৩১ ইঞ্চি সাধারণ এবং ৩৩ ইঞ্চি বর্ধিতকরণ বাধ্যতামূলক।
এছাড়া আরও সাতটি আলাদা ধাপ পার হতে হবে নিয়োগপ্রত্যাশীদের। এগুলো হচ্ছে-প্রাথমিক বাছাই, শারীরিক মাপ ও ফিজিক্যাল অ্যান্ডুরেন্স টেস্ট, লিখিত পরীক্ষা, মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষা, প্রাথমিক নির্বাচন, পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা। এই ধাপগুলো পেরিয়েই প্রশিক্ষণের জন্য চূড়ান্তপ্রার্থী বাছাই করা হবে।
আবেদন করতে হবে অনলাইনে:
নিয়োগপ্রার্থীদের অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। পুলিশ সদরদপ্তর তা যাচাই করে দেখবে। প্রার্থী মিথ্যা বা অসম্পূর্ণ তথ্য দিলে নিয়োগের যেকোনো পর্যায়ে তা বাতিল করা হবে। কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য যোগ্য আবেদনকারীদের মোবাইল নম্বরে একটি ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড পাঠানো হবে। শারীরিক সক্ষমতা ও কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য যোগ্য প্রার্থীদের অনলাইনে একটি কার্ড দেওয়া হবে। এরপর নেওয়া হবে প্রার্থীদের উচ্চতা, ওজন ও পুরুষ প্রার্থীদের বুকের মাপ।
শারীরিক সক্ষমতা পরীক্ষার আগে প্রার্থীকে ‘ইনডেমনিটি ঘোষণাপত্র’ ফরম পূরণ করতে হবে। ফরমে ওই প্রার্থী শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছে বলে ঘোষণা দিয়ে স্বাক্ষর করবেন। এরপর সাতটি ধাপে শারীরিক পরীক্ষা শুরু হবে। এগুলো হলো- দৌড়, পুশআপ, লং জাম্প, হাই জাম্প, ড্র্যাগিং ও রোপ ক্লাইমিং। এসব ধাপের কোনো একটিতে অকৃতকার্য হলে পরবর্তী ধাপের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যাবে না।
দৌড়ে পুরুষ প্রার্থীদের ২০০ মিটার দূরত্ব ২৮ সেকেন্ডে ও নারী প্রার্থীদের ২০০ মিটার ৩৪ সেকেন্ডে অতিক্রম করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পুশআপ ইভেন্টে পুরুষ প্রার্থীদের ৩৫ সেকেন্ডে ১০টি পুশআপ ও নারী প্রার্থীদের ৩০ সেকেন্ডে ১০টি পুশআপ নেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকা বাঞ্ছনীয়। লং জাম্পে পুরুষ প্রার্থীদের কমপক্ষে ১০ ফুট ও নারী প্রার্থীদের ৬ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। হাই জাম্পে পুরুষ প্রার্থীদের সাড়ে তিন ফুট ও নারীদের আড়াই ফুট উচ্চতা অতিক্রম করতে হবে। একজন প্রার্থী তিনবার জাম্প দেওয়ার সুযোগ পাবেন।
শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ে পুরুষ প্রার্থীদের এক হাজার ৬০০ মিটার দূরত্ব সাড়ে ছয় মিনিটে ও নারীদের এক হাজার মিটার দূরত্ব ছয় মিনিটে অতিক্রম করতে হবে। ড্র্যাগিং ইভেন্টে পুরুষ প্রার্থীদের ১৫০ পাউন্ড ওজনের টায়ারকে টেনে ৩০ ফুট দূরত্বে নিতে হবে। আর নারীদের ১১০ পাউন্ড ওজনের টায়ারকে ২০ ফুট দূরত্বে নিতে হবে। এ ছাড়া রোপ ক্লাইমিং পরীক্ষায় পুরুষদের ১২ ফুট এবং নারীদের ৮ ফুট দড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হবে।
শারীরিক সক্ষমতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সব ডকুমেন্ট নিয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। লিখিত পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত ও সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ে ৪৫ নম্বরের প্রশ্ন থাকবে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ১৫ নম্বরের মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। লিখিত, মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষায় নম্বরের ভিত্তিতে বিজ্ঞপ্তি অনুসারে জেলাওয়ারি মেধা তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীর উন্নয়নে সম্প্রতি যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এটি তার মধ্যে অন্যতম বলা যায়। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ ও পেশাদার পুলিশ সদস্য নিয়োগও জরুরি। যারা মেধা ও মননেও এগিয়ে থাকবে।’
বর্তমান পুলিশপ্রধানের ইতিবাচক উদ্যোগের প্রশংসা করে ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘বর্তমান আইজিপি একজন ডায়নামিক মানুষ। তার সময়ে পুলিশ সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কারণ বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনের প্রত্যাশা বেড়েছে। আমাদের রোগব্যাধিতে মৃত্যু আগের চেয়ে কমেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। পুলিশ সদস্য পদে নিয়োগপ্রত্যাশীদের সংখ্যা বেড়েছে। এসব বিবেচনা করলে পুলিশে এই সংস্কারটি প্রশংসনীয়। তবে এর যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। জ্ঞাতি-সম্পর্কের ব্যবহার, আঞ্চলিকতা ও রাজনৈতিক বিবেচনা-এই চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করা গেলে এই প্রক্রিয়াটি সময়োপযোগী, একথা বলতে দ্বিধা নেই।’
পুলিশের বর্তমান সদস্য সংখ্যা দুই লাখ ১২ হাজার। যাদের মধ্যে এক লাখ ২৩ হাজারই কনস্টেবল।


বিজ্ঞাপন